|
কলারোয়ায় রোরো ধান সংগ্রহ অভিযান কৃষকরা নেই ‘কৃষকের অ্যাপে’, নিয়ন্ত্রণে ফড়িয়ারা
আজকের কলারোয়া -
30/05/2023
# ৪০ কেজি ধানে ৫০ টাকা উৎকোচ গ্রহনের অভিযোগ গুদাম কর্মকর্তার বিরুদ্ধে
# নিন্ম মানের ধান ক্রয়ের অভিযোগ
# সিন্ডিকেটের দাপটে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত প্রান্তিক কৃষকরা
# উপজেলায় নিবন্ধিত কৃষক ৩৩ হাজার ২ শত জন
# আ্যপের মাধ্যমে আবেদন করেছে ১ হাজার ১৭ জন
# কৃষি অফিসও নিচ্ছে না কৃষকের খোঁজ............!!!!
ডেক্স : মধ্যস্বত্বভোগী ও ভারপ্রাপ্ত খাদ্য গুদাম কর্মকর্তার যোগসাজশে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ধান বিক্রি করতে পারছে না সাতক্ষীরার কলারোয়ায় প্রান্তিক কৃষকরা। ফলে বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায্যমূল্য থেকে। যদিও এসব সিন্ডিকেটের দাপট থেকে প্রান্তিক কৃষকদের রক্ষায় সরকারের খাদ্য বিভাগ সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে অ্যাপের মাধ্যমে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করেছে। যে অ্যাপের নাম ‘কৃষকের অ্যাপ’। তবে এ অ্যাপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না থাকা, ভারপ্রাপ্ত খাদ্য গুদাম কর্মকর্তার অবৈধ অর্থ দাবি, হয়রানীসহ বিভিন্ন কারনে গুদামে ধান বিক্রি করতে আগ্রহ নেই উপজেলার অধিকাংশ কৃষকের।
প্রান্তিক কৃষকদের অভিযোগ, খাদ্য গুদামে ধান বিক্রি করলে প্রতি বস্তায় (৪০ কেজি) ৫০ টাকা দিতে হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত গ্রদাম কর্মকর্তা মমতাজ পারভীনকে। এছাড়া রয়েছে স্থানীয় গুদাম সিন্ডিকেটের নানা হুমকি। কৃষকের ধানে মানতে হচ্ছে ১৪ ভাগ আর্দ্রতা নিরূপণের শর্তসহ নানা রকম হয়রানি। তবে, ফাড়িয়াদের নিকট থেকে ধান ক্রয়ে নেই কোন ঝামেলা। দেখা হচ্ছে না ধানের আর্দ্রতা। অতি সহজে নিন্ম মানের ধান গুদামে ক্রয় করা হচ্ছে। গুদাম কর্মকর্তা এসব ফাড়িয়াদের নিকট থেকে বস্তা প্রতি (৪০ কেজি) ৫০ থেকে ৬০ টাকা উৎকোচ নিয়ে অতি নিন্ম মানের ধান ক্রয় করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তারা অভিযোগ তুলে আরও বলেন, উপজেলায় প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকদের মাঝে সরকারিভাবে ধান বিক্রির বিষয়ে কোনো প্রচারণা চালানো হয়নি। পরিচিত ও সিন্ডিকেটভুক্ত কৃষকদের মাধ্যমে ‘কৃষকের অ্যাপে’ আবেদন করে ধান ক্রয় করা হচ্ছে। ধান ক্রয়ে দুর্ণিতী, কৃষক হয়রানী বন্ধ ও উপজেলার প্রান্তিক কৃষকদের রক্ষায় অবিলম্বে দুর্নিতীবাজ উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান ও সিন্ডিকেট প্রধান ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তা মমতাজ পারভীনকে অপসারনের দাবি জানান। একই সাথে গুদামের দুর্নিতী তদন্তে দুর্নিতী দমন কমিশনের (দুদক) হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
কলারোয়া উপজেলা খাদ্য অফিস সুত্রে জানাগেছে, চলতি বোরো মৌসুমে উপজেলা থেকে ৯৮৫ মেট্রিক টন ধান ৩০ টাকা কেজি দরে সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে ক্রয় করা হবে। চলবে ৩১ আগষ্ট পর্যন্ত। গত ২১ মে আনুষ্ঠানিকভাবে ধান ক্রয়ের উদ্বোধন করা হয়।
এদিকে, ওই অ্যাপের মাধ্যমে ধান ক্রয় শুরু হলেও কৃষি অফিস সূত্রে জানাগেছে, উপজেলায় নিবন্ধিত ৩৩ হাজার ২শত কৃষকের মধ্যে এখন পর্যন্ত (২৯ মে) নিবন্ধন করেছেন মাত্র ১ হাজার ১৭ জন কৃষক। এর মধ্যে ৭২৮ জন কৃষকের নামের তালিকা খাদ্য গুদাম কতৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছে। বাকি নামের তালিকা পাঠানোর জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, চলতি বছর বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৭ হাজার ৫শত মেট্রিক টন। তবে লক্ষমাত্রা ছাড়িয়ে উৎপাদন আরো বেশি হয়েছে।
সরজমিনে কলারোয়া উপজেলা খাদ্য গুদাম ঘুরে কৃষকের দেখা না পেলেও উপস্থিতি ছিলো একাধিক সিন্ডিকেট সদস্য। ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তা মমতাজ পারভীনের উপস্থিতিতে খাদ্য বিভাগের নিজস্ব বস্তায় ট্রলি ভর্তি ধান প্রবেশ করছে। রাখা হচ্ছে গুদামের বিভিন্ন স্থানে সারিবদ্ধ ভাবে। পরে ক্রয় দেখিয়ে গুদাম ভর্তি করা হচ্ছে। তবে, সরবরাহকৃত ধানগুলি সিন্ডিকেটের হওয়ায় দেখা হচ্ছে না ধানের আদ্রতা। এছাড়া চিটাসহ নিন্ম মানের ধান ক্রয় করা হচ্ছে। গুদামের প্রধান ফটক বন্ধ রেখে ভিতরে অবস্থান করছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। প্রান্তিক কৃষক ধান বিক্রির জন্য গুদামে প্রবেশ করলে বলা হচ্ছে পূর্বে আবেদন করা না থাকলে ধান ক্রয় করা সম্ভব নয়। যদিও উপজেলা কুষি জানায়, আ্যাপের মাধ্যমে আবেদন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এছাড়া কৃষি অফিস থেকে পাঠানো (ধান বিক্রির জন্য) আবেদকৃত কৃষকের তালিকা দেখাতে পারেনি ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তা! একদিন আগে গুদামে ক্রয় করা নিন্ম মানের ধানের নমুনা (সংগ্রহ করা) দেখিয়ে ধানের আদ্রতা ও চিটার বিষয়ে দেখালে ক্ষুদ্ধ হন ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তা মমতাজ পারভীন। তিনি বলেন, পূর্বে যেসব ধান ক্রয় করে গুদামে রাখা হয়েছে সেগুলি এখন দেখিয়ে কি হবে ?
এদিকে দুপুর পর্যন্ত গুদামে অবস্থান করেও কোন কৃষকের নিকট থেকে ধান ক্রয় করতে দেখা যায়নি বরং তালিকায় নাম নেই এমন অযুহাত দেখিয়ে একজন প্রান্তিক কৃষককে ফেরত
পাঠাতে দেখাগেছে। যদিও ভারপ্রাপ্ত গুাদাম কর্মকর্তা মমতাজ পারভীন দাবি করেন, সরকারের সকল নিয়ম মেনে সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে ধান ক্রয় করা হচ্ছে।
কেড়াগাছি ইউনিয়নের আব্দুল খালেক নামে এক কৃষক বলেন, কৃষকের ধান কিনলে অফিসারের বেশি লাভ হয় না, সেজন্য ফাড়িয়াদের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে নিন্ম মানের ধান ক্রয় করছে। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, এক পরিবারের একাধিক সদস্যের নামে আবেদন করছে, তারা সবাই ধান বিক্রি করছে, এদের মধ্যে বড় ব্যবসায়ীও রয়েছে। এখন দেখছি ব্যবসায়ীরাও কৃষক হয়ে গেছে! একই এলাকার কৃষক কুদ্দুস গাজী বলেন, ‘কৃষক না, নিজের জমি নাই, এমন লোকও কৃষকের অ্যাপে আবেদন করছে। আবার নিজের আবাদ নাই, আরেক মিলার বা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সিন্ডিকেট করে ধান এনে বিক্রি করছে কেউ কেউ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগে গোডাউনে (খাদ্য গুদাম) কার্ড দিয়া ধান বিক্রি করা যেত, এখন মোবাইলে আবেদন করতে হবে। তবে, এই বিষয়টা সবাই জানেই না। গোডাউনের কোনো লোক আসে নাই, কৃষি অফিসেরও কোনো লোক আসে নাই। আমরা জানবো কেমন করে।’
হেলাতলা ইউনিয়নের কৃষক রফিকুল জানান, ‘ধান বিক্রির জন্য আবেদন করে লাভ কি ? ধান নিয়ে গেলেই অফিসার বলতে শুরু করে ধানে চিটা আছে, ধানের সাইজ ঠিক নাই। অথচ টাকা দিলেই স্যার (ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্ত মমতাজ পারভীন) এই ধান নিয়ে আর কথা বলে না। একই অভিযোগ করে কৃষক রশিদ বলেন, ধান বিক্রি করতে গেলে কত নিয়মের কথা যে শোনায়! আবার খাদ্য গুদামের অফিসারকে খরচাপাতি দিলেই (৪০ কেজি ধানে ৫০ টাকা) ধান নিয়ে আর কথা বলে না। গুদামে কিনে নেয়।’
অপরদিকে উপজেলা খাদ্য গুদাম সংলগ্ন একাধিক ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের এক সদস্য (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) জানান, গুদামের পার্শ্ববর্তী ধান ব্যবসায়ী দীপক প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ ট্রলি ধান গুদামে বিক্রি করছে। এছাড়াও গুদাম সিন্ডিকেটের ১০/১২জন সদস্য দিনভর গুদামে অবস্থান করে নিয়মিত ধান বিক্রি করছে। তারা বলেন, খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা এসব সিন্ডিকেটের নিকট থেকে মন প্রতি ধান (৪০ কেজি থেকে ৫০ টাকা ও সরকারি বস্তা বাইরে ব্যবহারের জন্য বস্তা প্রতি ৫টাকা উৎকোচ নিচ্ছেন। জানাগেছে, এসব নিন্ম মানের ধান অন্য জেলা থেকে কম মূল্যে ক্রয় করে কলারোয়া খাদ্য গুদামে বিক্রি করা হচ্ছে। এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মাধবকাটি, তুজুলপুর ও ঝাউডাঙ্গা বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীর অন্য জেলা থেকে ট্রাকে নিয়ে এসে ফাড়িয়াদের কাছে বিক্রি করছে। যে ধানেই কলারোয়া খাদ্য গুদাম ভর্তি হচ্ছে।
কলারোয়া উপজেলা ভারপ্রাপ্ত খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা (ওসিএলএসডি) মমতাজ পারভীন সিন্ডিকেটের নিকট থেকে ধান ক্রয়, অর্থ গ্রহন ও কৃষক হয়রানির বিষয়ে অস্বীকার করে করে বলেন, কৃষি অফিস থেকে পাঠানো কৃষকের তালিকা অনুযায়ী ধান ক্রয় করা হচ্ছে। এখানে সিন্ডিকেটের কোন প্রশ্নই আসে না, কারন একজন কৃষকের নিকট থেকে ৩ টন ধান ক্রয় করা হচ্ছে এবং ব্যাংক এর মাধ্যমে আমরা টাকা দিচ্ছি। গুদামে ফাড়িয়ারা ধান বিক্রি করার বিষয়ে গুদাম কর্মকর্তা বলেন, যদি তালিকাভুক্ত কৃষকরা ধান বিক্রি করতে তাদের উপর দায়ীত্ব দেয় সেখানে আমার কিছুই করনীয় নেই! কোথা থেকে ধান নিয়ে আসছে সেটাও আমার জানানেই। তবে, এক জন কৃষকের নিকট থেকে সর্বচ্চো ৩ টন ক্রয় করা হচ্ছে। তবে সব কিছুই সরকারের নিয়ম মেনে হচ্ছে বলে এই বর্ককর্তা দাবি করেন।
গুদামে সিন্ডিকেটের ধান বিক্রি ও আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান অর্থিক অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, সরকারের ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী গুদামে ধান ক্রয় করা হচ্ছে। তবে, সিন্ডিকেটের বিষয়ে এই কর্মকর্তা নিজেকে অসহায় বলে মন্তব্য করেন। নিন্ম মানের ধান ক্রয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান ক্ষুদ্ধ হয়ে বলেন, আপনার এসব জানার প্রয়োজন নেই! সাতক্ষীরা জেলার ৯/১০ জন বড় বড় সাংবাদিকের সাথে আমার কথা হয়! তবে, এসব বড় সাংবাদিকদের নাম তিনি প্রকাশ করতে রাজি হননি।
কলারোয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আবুল হোসেন জানান, যে সব কৃষক আ্যাপের মাধ্যমে আবেদন করছে আমরা তাদের তালিকা খাদ্য অফিসে পঠিয়ে দিচ্ছি। আজ (২৯ মে) পর্যন্ত ১০১৭ জন কৃষক ধান বিক্রির জন্য আবেদন করেছে। এরমধ্যে ৭২৮ জনের তালিকা প্রথমেই খাদ্য কর্মকর্তার অফিসে পাঠানো হয়েছে। বাকি কৃষকদের নামের তালিকা আজ দুপুরে (২৯ মে) পাঠানো হবে। আবেদন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে জানিয়ে কৃষি কর্মকর্তা বলেন, খাদ্য অফিস নিষেদ করলে আমরা আর তালিকা পাঠাবো না। গুদামে কৃষক হয়রানি, সিন্ডিকেটের ধান ক্রয় এবং আ্যাপের প্রচার প্রচারণার বিষয়ে বলেন, অনিয়মের বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। আর এসব কাজ খাদ্য অফিসের। তারপরও আমাদের উপ-সহকারি কৃষি অফিসাররা মাঠ পর্যায়ে ধান বিক্রির বিষয়ে প্রান্তিক কৃষকদের প্রচার করেছে।
|