|
মুক্তিযুদ্ধে সাতক্ষীরা
আজকের কলারোয়া -
25/03/2018
গৌরব গাঁথা মহান মুক্তিযুদ্ধে সাতক্ষীরায় গণহত্যায় শহীদ হয়েছিলেন ৩৬০ জন। এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদরে ৯১ জন, কলারোয়ায় ৩৮জন, তালায় ১১৫জন, আশাশুনিতে ২৫জন, দেবহাটায় ১৯জন, কালিগঞ্জে ৩৪জন এবং শ্যামনগরে ৩৮জন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাতক্ষীরায় ১৬টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পাকিস্তানী পতাকায় আগুন, তৎকালীন এসডিওকে গ্রেপ্তার, ট্রেজারিতে হামলা ও অস্ত্র লুট এবং সোনালী ব্যাংক লুটসহ বেশ কয়েকটি ঘটনায় সাতক্ষীরায় মুক্তিযুদ্ধ বেগবান হয় এবং এসব ঘটনায় মুক্তিপাগল জনতার মনে শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে জানা যায়, ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই আন্দোলনের পক্ষে সাতক্ষীরার মানুষকে জাগ্রত করে জাতীয় চেতনার সাথে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে এখানে আন্দোলনের মূল ¯্রােতটি নির্মিত হয়েছিল। ১৯৬৮ সলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ২৮ জনকে আসামী করা হয়। এই মামলায় ১০ নং আসামী ছিলেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলারপাঁচরকি গ্রামের রুহুল কুদ্দুস (সি.এস.পি) এবং ১১নং আসামী ছিলেন তার খালাতো ভাই মোহাম্মদ মহসীন। এছাড়া কলারোয়ার হঠাৎগঞ্জ গ্রামের ই.পি.আর নায়েক সুবেদার আশরাফ আলী খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আটক ছিলেন বলে জানা যায়। অনেকেই অভিযুক্ত হন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে সাতক্ষীরায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। ২৫ মার্চ ১৯৬৯ জেনারেল ইয়াহিয়া দ্বিতীয় বারের মত মার্শাল ‘ল’ জারি করেন। জাতীয় পরিষদ বাতিল করে নিজে স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট হয়ে দেশের অন্যান্য স্থানের মত সাতক্ষীরায়ও বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করা হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচন বাঙালি জাতির জন্য এক গৌরবময় অধ্যায়। স্বাধীকার আর স্বাধীনতার চেতনায় বাঙালি জাতি আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে বিজয় লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে সাতক্ষীরার ৫টি আসন থেকেই সেদিন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়লাভ করে। ১ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন বন্ধ ঘোষণার পরপরই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য স্থানের মত সাতক্ষীরার বীর বাঙালিরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২ মার্চ এখানে স্বত:স্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়। সারাদেশের মত সাতক্ষীরাতেও বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। রাজপথে বের করা হয় খন্ড খন্ড মিছিল। ৩ মার্চ জারিকৃত কারফিউ অমান্য করে পাকসেনাদের দোসরদের হাতে সারাদেশের মত সাতক্ষীরার রাজপথ রক্তে রাঙা হয়ে ওঠে। সাতক্ষীরা কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি কোর্ট এলাকায় এলে লোকসংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায়। সেদিনের স্লোগান ছিল- জয় বাংলা/আর নয় অধীনতা, এবার চাই স্বাধীনতা/বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর ইত্যাদি। মিছিলটি এক পর্যায়ে বিশালাকৃতিতে রূপ নেয় এবং পাকাপুল (বেইলি ব্রিজ) পার হয়ে চাপড়া লজের নিকট এলে চাপড়া লজ থেকে ঐ মিছিলের উপর মুসলিম লীগ নেতারা গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে শহীদ হন রিক্সা চালক আব্দুর রাজ্জাক। আহত হন অনেকেই। এরপর উত্তেজিত জনতা পেট্রোল পাম্প থেকে পেট্রোল নিয়ে চাপড়া লজে আগুন লাগিয়ে দেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে সাতক্ষীরার প্রথম শহীদ আব্দুর রাজ্জাককে প্রাণসায়ের দীঘির পূর্ব পাশে কবর দেয়া হয়। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” এই ভাষণ শুনে সারা দেশের মত সাতক্ষীরার আপামর মুক্তিপাগল জনতা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কেন্দ্রের নির্দেশ মোতাবেক ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে বাংলাদেশ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রতিটি জেলা, মহকুমা ও থানা সদরে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৮ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা তৎকালীন এস. ডি. ও অফিস থেকে নামিয়ে নেয় জিন্নাহর ছবি। একই দিনে কালিগঞ্জ সোহরাওয়ার্দি পার্কে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। নকিপুর ছাত্রলীগ কার্যালয়ে, নকিপুর হাইস্কুল ও শ্যামনগর থানাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। দেবহাটায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে থানা চত্তরে বিশাল এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পক্ষে পথনামা পাঠ করানো হয় এবং স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের বিরোধিতা করে সাতক্ষীরাতে পাকাপুলের মোড়ে তোলা হয় সবুজের মাঝে লাল রঙের সূর্যের ভেতর বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা। পুলিশ বাহিনী ও ছাত্ররা আনুষ্ঠানিকভাবে এই পতাকার প্রতি অভিবাদন জানায়। পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো হয়। ছাত্রনেতাদের জ্বালাময়ী ভাষণে সাড়া দিয়ে সংগ্রামী সাতক্ষীরাবাসী জানান দেয় তারা দেশ রক্ষার যুদ্ধে প্রস্তুত। ২৫ মার্চ নেমে আসে কালো রাত। সারাদেশ জুড়ে চলে পাকিস্তানি হানাদারদের নারকীয় তান্ডবলীলা। ঐ রাতেই পাক বাহিনীর বর্বরতার খরব ওয়ারলেসে সাতক্ষীরাতে পৌঁছে যায়। তৎকালীন সাতক্ষীরা জেলার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে ওই তথ্য প্রদান করেন। অত:পর আওয়ামী লীগ নেতারা সাতক্ষীরা শহরে মাইকযোগে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
ঐ রাতেই ছাত্র নেতারা ইপিআর ক্যাম্পগুলো ঘুরে ঘুরে তাদের সমর্থন আদায় এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান পৌঁছে দেন। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সাতক্ষীরাতেও স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এবং স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ে সাতক্ষীরার সর্বত্র ব্যাপক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়।
সাতক্ষীরার প্রতিটি থানায়ও স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ২৬ মার্চ সাতক্ষীরায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবর্গ, আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিকামী বীর জনতা বর্বর পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার লক্ষ্যে সাতক্ষীরাগামী দুটো প্রধান সড়কের কদমতলা ও বনেরপোতা এলাকায় রাস্তা কেটে ও গাছ ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে।
থানাঘাটা ও লাবসার দু’টি কাঠের পুল খুলে ফেলা হয়। তাছাড়া শাকদহ ও পাটকেলঘাটা ব্রিজের কাছে পিচের রাস্তা কেটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এসব দু:সাহসিক কাজে স্থানীয় সর্বস্তরের জনগণ শাবল, কোদাল, কুড়াল, ঝুড়ি দিয়ে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও কর্মীদের সহযোগিতা করেন।
রাতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং গ্রেপ্তার হন পাকিস্তানিদের হাতে। এদিকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় কর্মকান্ডকে আরো গতিশীল ও পরিচালনা করার জন্য বর্ধিত আকারে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।
২৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ডাকের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন মেজর জিয়া। ঐ দিনই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আব্দুল হান্নান আরো একটি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন। সাতক্ষীরার পিএন হাইস্কুল মাঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ জনতা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার ও মুজাহিদ বাহিনী সমবেত হয়।
২৮ মার্চ তালা ডাক বাংলো চত্তরে ছাত্রনেতারা পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে তা পুড়িয়ে দেয় এবং স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। ২৮ মার্চ ছাত্র লীগ ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে সাতক্ষীরায় সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সকলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
এদিন বিকালে ভারতের কালুতলা বাজারের কালীমন্দির প্রাঙ্গণে এক জনসভায় সাতক্ষীরার মুক্তিকামী জনতার পক্ষ থেকে মুক্তি সংগ্রামে ভারতীয় জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতার আহ্বান জানান। ৫ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা দেবহাটায় বিওপি ক্যাম্পে অতর্কিতে আক্রমণ করে ৬টি চাইনিজ রাইফেল, কিছু থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও প্রচুর পরিমাণে গুলি হস্তগত করে।
৮ এপ্রিল ৩ প্লাটুন ইপিআর পাক বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধকল্পে পাটকেলঘাটা, কদমতলা ও আশাশুনিতে অবস্থান নেয়। সাতক্ষীরা সদর থানার সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরের আম বাগানে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ সতক্ষীরা ট্রেজারি থেকে সাড়ে তিন শত থ্রি নট থ্রি রাইফেল এবং প্রচুর পরিমাণে গুলি লুট করে এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মহকুমা প্রশাসককে আটক করে। ১৯ এপ্রিল ৩০-৩৫ জন ইপিআর এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা তিন খানা গাড়ি নিয়ে রাত ৮টার দিকে সাতক্ষীরার ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে নগদ ১ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা, এন মণ সোনা, আধা মণ রূপা ভোমরা বরাবর ভারতের বশিরহাট মহকুমার ট্রেজারিতে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের নামে জমা দেয়। ২১ এপ্রিল পাকবাহিনীর বাঙালি এজেন্ট তথা রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের প্ররোচনায় সাতক্ষীরার বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা মিলিটারিদের হাতে ধরা পড়েন এবং পাক সেনারা রেজিস্ট্রি অফিসের মাঠে ফেলে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করার পর তাদের বাড়ি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। এরই মধ্য দিয়ে সংগঠিত হতে থাকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
এক একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যেতো শতগুণে। মৃত সহযোদ্ধার রক্ত ছুঁয়ে তারা শপথ নিত, মাতৃভূমিকে হানাদার বাহিনী মুক্ত করার। এক একটি মুক্তিযোদ্ধার লাশের বদলে শত সহ¯্র খান সেনাদের লাশ চাই। মূলত এপ্রিল মাস থেকেই সাতক্ষীরার বিভিন্ন অঞ্চলে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি যুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ সাতমাস ধরে ভোমরা, টাউন শ্রীপুর, গোপালপুর, বয়ারগাতি, পিরোজপুরসহ একাধিক স্থানে যুদ্ধ চলে। এসব যুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে শহীদ হন অনেক বাংলা মায়ের মুক্তি পাগল বীর সন্তান। অনেক মা-বোনেরা হারান তাদের সম্ভ্রম। ১৯ নভেম্বর বাংলার দামাল ছেলেদের হাতে মুক্ত হয় শ্যামনগর। ২০ নভেম্বর কালিগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয়। ৩০ নভেম্বর যুদ্ধের শেষ দিকে দু:সাহসিক এক অভিযানে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছায়। পাকসেনাদের অত্যন্ত কড়া বেষ্টনী ভেদ করে মুক্তিপাগল বীর মুক্তিসেনারা ডিনামাইট চার্জ করে ‘পাওয়ার হাউস’ উড়িয়ে দেয়। সাতক্ষীরা শহরকে তারা পরিণত করে ভুতুড়ে শহরে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সফল অভিযানে পাক সেনারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ৪ ডিসেম্বর শ্যামনগর আর কালিগঞ্জ থেকে পিছু হটে পারুলিয়াতে ঘাটি করা পাক বাহিনীর উপর রাতে অতর্কিতে হামলা চালায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। হানাদার বাহিনীরা কুলিয়া ব্রিজের কাছে নতুন অবস্থান নেয়। ৫ ডিসেম্বর ভোর বেলা আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিসেনারা ৪ জন পাক সেনাকে হত্যা করে। প্রচন্ড যুদ্ধে শহীদ হন ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা, আহত হন অনেকেই। সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা নতুন করে সংগঠিত হয়ে আক্রমণ করলে পাক সেনারা কুলিয়া ব্রিজ ছেড়ে বাঁকাল ব্রিজের কাছে অবস্থান নেয়। পথিমধ্যে কুলিয়া ব্রিজ এবং আলীপুর লোহার সেতু ধ্বংস করে।
৬ ডিসেম্বর বেলা ১১টার সময় অল ইন্ডিয়া রেডিও মারফত খবর আসে ভারত বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্ব জনমত সুদৃঢ় হয় বাংলাদেশের পক্ষে। পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়। দেবহাটা ও কলারোয়া হানাদার মুক্ত হয়। রাতের আঁধারে পাক হানাদাররা পালিয়ে যায় সাতক্ষীরা থেকে। যাওয়ার সময় সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশের প্রধান তিনটি ব্রিজ; বাঁকাল, কদমতলা ও বিনেরপোতা ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে নত শিরে পলায়ন করে। বিদ্যুৎ গতিতে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।
৭ ডিসেম্বর চতুর্দিক থেকে ফাঁকা গুলির আওয়াজ করতে করতে শহরে প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধারা। পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনার আনন্দে স্বজন হারানোর ব্যথা ভুলে গিয়েছিল তারা। মুক্তির নেশায় উন্মত্ত দামাল ছেলেরা এদিন সাতক্ষীরার মাটিতে প্রথম স্বাধীনতার বিজয় পতাকা ওড়ায়। বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত জয়ের নিশান উত্তোলনের সাথে সাথে ফাঁকা গুলির আওয়াজ আর আনন্দ-উল্লাসে মুখরিত হয় কোর্ট প্রাঙ্গণ (বর্তমানে পুরাতন জজ কোর্ট)।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সাতক্ষীরা এলাকার গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নিশ্চিহ্ন হবার পথে। এমনকি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবরগুলো রয়েছে অবহেলায়। আজও সেসব কবরগুলো চিহ্নিত করা হয়নি। গণকবরগুলোর মধ্যে বর্তমানে সাতক্ষীরা সরকারি হাইস্কুলের পিছনে গণকবর, ঝাউডাঙ্গা হাইস্কুলের উত্তর পশ্চিম কোণে রাস্তার পাশে, বালিয়াডাংগা বাজার, মুরারিকাটি পালপাড়া, কলারোয়া ফুটবল মাঠের রাস্তা সঙলগ্ন দক্ষিণ পাশে, গয়ড়া বাজার, সোনাবাড়িয়া মোড় ও হিন্দুপাড়া, বামনখালি ঘোষপাড়া, সদর উপজেলার মাহমুদপুর আব্বাস মিয়ার বাড়ির পাশে, মাহমুদ স্কুলের উত্তর ও পূর্ব পাশে, তালার পাকুমিরা, আশাশুনির মানিকখালি ও শ্যামনগরের হরিনগর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এদেশীয় রাজাকার, আলবদর আল শামসদের সহযোগিতায় খান সেনারা সদরের বাঁকাল ব্রিজের নিচে, মাহমুদপুর স্কুলে, শহরের আট পুকুরে, বিনেরপোতা ব্রিজের নিচে, পারুলিয়া খালে, পাটকেলঘাটা ব্রিজের পাশে, কাকশিয়ালি ব্রিজের নিচে, কালিগঞ্জ ওয়াপদা স্লুইসগেট ও ডাক বাংলো চত্তরে, শ্যামনগরে আনসার ভিডিপি কর্মকর্তার অফিস চত্তরে ও কাতখালির খেয়াঘাটে সাধারণ মানুষদের নিয়ে নির্বিচারে নির্যাতন করতো। এসব জায়গাগুলোও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। তরুণ প্রজন্মের কাছে এসব স্থানগুলোর পরিচয় তুলে ধরে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শাণিত করার এখনই সময়।
|