Home
 
৪০ বছর চা বিক্রি সংসার চালাচ্ছেন
কলারোয়ায় মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফার খান

আজকের কলারোয়া - 29/03/2018
সরকারের ভাতার টাকা দিয়ে সংসার চলে না। এছাড়া আমি অসুস্থ্য প্রতিদিন ঔষধ খেতে হয়। মাসে অনেক টাকা খরচ। সে কারনে বাজারে ৪০ বছর আগে (১৯৭৮ সালে) এই ছোট চায়ের দোকান করি। সারাদিন চা-পান বিক্রি করে কিছু টাকা লাভ হয় সব মিলিয়ে কোন প্রকার দিন কেটে যাচ্ছে। তবে আমার কষ্ট হলেও দেশের উন্নয়ন হচ্ছে এতেই আমি খুশি। কথাগুলি বলছিলেন, কলারোয়া উপজেরার দেয়াড়া ইউনিয়নের কাশিয়াডাঙ্গা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর খান (৭৬)। তিনি একই গ্রামের মৃত, জহুর আলী খানের ছেলে। ১৯৭১ সালে ২৭ বছরের এই যুবক এক বছর বয়সী ছেলে ও স্ত্রী হাসিনা খাতুনসহ পরিবারকে রেখে দেশ স্বাধীনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি ছেলে ও তিন মেয়ের জনক মুক্তিযোদ্ধ মোজাফ্ফর খান। অর্থের অভাবে সন্তানদের খুব বেশী লেখাপড়া করাতে পারেননি। সব ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তিন ছেলেই এলাকায় কৃষি কাজ করে সংসার চালায়। ছোট ছেলের সংসারে থাকেন দেশের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্ত্রী হাসিনা খাতুন। তবে নিজ উপার্জনের টাকা দিয়ে ঔষধ কেনাসহ সকল খরচ ও স্ত্রীকে নিয়ে কাটাচ্ছেন জীবনের শেষ দিনগুলি। এছাড়া তিনি ছেলে-মেয়েদেরও বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সহযোগিতা করেন। সরজমিনে কাশিয়াডাঙ্গা বাজারে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর খানের চায়ের দোকানে গেলে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় তিনি মুক্তিযুদ্ধের পর পাপ্ত কিছু সনদ দেখান। ৯৮১ নং গ্রেজেটধারী মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর খানের মুক্তিযোদ্ধা সাময়িক সনদ নং ম-৩৮৬৪৮, মুক্তিবার্তা নং- ০৪০৪০৩০১৯২। মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর খান জানান, বঙ্গবন্ধু’র ডাকে দেশ স্বাধীনের জন্য মুক্তি বাহিনীতে যোগদেয়। পরে আমাদেরকে ভারতে নিয়ে যায়। সেখানে আমাদের শত্রু মোকাবেলার বিভিন্ন প্রশিক্ষন দেয়া হয়। প্রশিক্ষন শেষে দেশে ফিরে এসে ৮নং সেক্টরে কমান্ডার মঞ্জুরুল রহমানের নেতৃত্বে যশোর জেলার ঝিকরগাছা, কেশবপুর, মনিরামপুর কলারোয়া উপজেলার কপোতাক্ষ নদের তীরবর্তী ত্রিমোহিনীসহ বিভিন্ন এলাকায় পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক সম্মুখ যুদ্ধ কয়েকটি পাক-হানাদারদের ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে তাদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়। কমান্ডার মঞ্জুরুল রহমানের নেতৃত্বে আমরা ১৭ জনের একটি দল যশোর জেলার ঝিকরগাছা, মনিরামপুর এলাকায় (সবচেয় বেশী) কমান্ডারের নির্দেশে যুদ্ধ করেছি। যুদ্ধের সময় আমরা অনেক পাক সেনাকে হত্যা করেছি আবার আমাদের অনেক সহযোদ্ধা জখম হয়েছে কয়েকজন শহীদ হয়েছেন। তিনি আবেগ জড়িত কন্ঠে বলেন, যুদ্ধের শেষের দিকে আমার বন্ধু ও প্রিয় সহযোদ্ধা আব্দুল জব্বার পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন। তাকে হারানোর পর আমি কিছু সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে ছিলাম। পরে নিজের মনেবল দৃঢ় এবং পিছুটান না থাকায় আমরা আরো কঠোর হয়ে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করেছি। সারাদেশের বীর যোদ্ধাদের মায়ের দেশ স্বাধীন নয় মাস করতে কঠোর হামলা চালানোর অবশেষে শক্তিশালী পাক-বাহিনীকে পরাজিত কওে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ দেশ স্বাধীন হয়, বিতাড়িত করা হয় পাক-হানাদার বাহিনীকে। যদিও তার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের অবিরাম হামলা চালিয়ে ৬ ডিসেম্বর,১৯৭১ কলারোয়া উপজেলা থেকে পাক হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করা হয়। সেই দিনই উপজেলা সদরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন বীর সহযোদ্ধারা। কিছু সময় স্থীর চোখে তাকিয়ে আবার বলেন, এখন বয়স হয়েছে, শরীরটা যেন মাজে মাঝে থমকে যায়, তবে মন আজও দূর্বল হয়নি। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাক বাহিনীর আক্রমনে তিনি কোমরে প্রচন্ড আঘাত হন। যার ক্ষত ও ব্যাথা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন। তবে বৃদ্ধ বয়সে কোমরের আঘাতটা প্রচন্ড ব্যাথা হওয়ায় যেন বেশী কষ্ঠ পাচ্ছে। তিনি জানান, কয়েক বছর আগে চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছিলাম, সেখানে ডাক্তার বলেছে অপারেশন করতে হবে, অনেক টাকার প্রয়োজন। যেটা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। সেজন্য ডাক্তারের লেখা ঔষধ নিয়মিত খাচ্ছি। তাতে ব্যাথাটা একটু কম হয়। সরকারের সহযোগিতার বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর খান বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়াদিয়ে পরিবার, সন্তান, স্ত্রী ফেলে যুদ্ধ করতে গেছি। কিছু পাওয়ার বা নেয়ার জন্য যুদ্ধ করেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জীবিকার তাগিদে ১৯৭৮ সাল থেকে এই বাজারে চা বিক্রি করছি। এখানে সবাই আমার ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে। তিনি বলেন, সরকারের দেয়া ভাতার টাকা নিয়মিত পান। তবে আগে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার টাকা কম ছিলো, সুযোগ-সুবিধাও অনেক কম দেয়া হতো। এখন শেখের বেটি ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক উপকার করেছে। আমাদের ভাতার টাকা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়েছে। এর ফলে অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের উপকার হয়েছে। আমি নিজেও সরকারি ভাতার টাকা দিয়ে ঔধদ কিনে খায়। এছাড়া বাকী টাকা দিয়ে সংসার ও ছেলে-মেয়েদের পিছনে খরচ করি। সরকারের বরাদ্ধকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাড়ী না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এই বীর বলেন, বাড়ী না পাওয়ার কোন কষ্ট আমার নেই, বেঁচে থাকলে হয়ত একদিন পাবো। আমার শুধু একটাই চাওয়া ‘শেখের বেটি যেন আবারো ক্ষমতায় আসতে পারে’। তিনি বলেন, শেখের বেটি ক্ষমতায় থাকলে মানুষ আরো সুখি থাকবে এমনটায় বিশ্বাস এই রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধ্রা। স্ত্রী হাসিনা খাতুন জানান, খুব সহজ সরল মানুষ তিনি। এই বয়সে অসুস্থ্য শরীরে সারা দিন চা বিক্রি করে এবং প্রতি মাসের ভাতার টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হয়। এর মধ্যে যুদ্ধের সময় আঘাত প্রাপ্ত কোমরের ব্যাথার জন্য প্রতিমাসে ঔষধ কিনতে হয়। ছেলেরাও মাঠে কাজ করে সংসার চালায় তাদেরকেও সহযোগিতা করতে হয়। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে সরকারের নিকট তার সু-চিকিৎসার ব্যবস্থা, থাকার জন্য একটা বাড়ী ও আর্থিক সহযোগিতা কামনা করেন। স্থানীয় দেয়াড়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহাবুবর রহমান মফেসহ বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কলারোয়া উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারের বরাদ্ধকৃত বাড়ী মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর খানকে কেন আগে দেয়া হলো না এজন্য তারা বিস্ময় প্রকাশ করেন। তারা অবহেলিত এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য স্থানীয় এলাকাবাসী মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন।


 



গন্তব্য কলারোয়া    
Product Image Product Image


 
    
Copyright : Kalaroa.com, 2019
Email : info@kalaroa.com